মরমী শিল্পী এবং লোক সংগীত সম্রাট আব্বাস উদ্দিন তখন কুচবিহারে থাকেন। তার সাথে কাজী নজরুল ইসলামের বেশ সখ্যতা। নজরুল ইসলাম তখন শ্যামা সংগীত নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন -আব্বাস উদ্দিন ভাটিয়ালী ,ভাওয়াইয়া ,পল্লীগীতি ও গজল গেয়ে চলছেন-তাকে বলা হলো ভাইয়াই গানের সুর সম্রাট কিন্তু মনে তার তৃপ্তি নেই।কারন একমাত্র তিনিই নিজ নামে সংগীতের সুর রচনা এবং কন্ঠ দিতেন। বাকীরা ছদ্ম নামে।
তিনি একদিন গেলেন কাজীর বাসায়। বললেন -আপনি একটা ইসলামী সংগীত লেখেন। মুসলমানদের জন্য তেমন কোন সংগীত নেই ,মুসলমান যে কজন শিল্পী আছে তারা হিন্দু নাম ব্যবহারে করে সংগীত গেয়ে যাচ্ছেন।সব হিন্দুদের দখলেই পড়ে আছে-আমরা চেতনা জাগ্রত করার জন্য একটা সংগীত দরকার।
তখন গ্রামোফোন (কলের গান) এর প্রচলন ছিল খুব।
কলকাতার বিশিষ্ট গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্ণধার ভগবতী বাবুদের দখলে সব। তিনি নজরুলকে দিয়ে শ্যামা সংগীত রেকর্ডিং করে যাচ্ছেন একটার পর একটা।তাই কাজী নজরুল আব্বাস উদ্দিন আহমেদকে বললেন -আপনি ভগবতী বাবুর সাথে আলাপ করে দেখুন -উনাকে রাজি হলে আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
দীর্ঘ ছয় মাস ধরে আব্বাস উদ্দিন আহমেদ ভগবতী বাবুর পিছনে ঘুরলেন। উনি কিছুতেই ইসলামী সংগীত রেকর্ডিং করতে রাজি নয়। তার মতে এতে সময় নষ্ট হবে। তাছাড়া যদি শ্রোতাদের মনে দাগ না পড়ে তাহলে পুরাটাই লস।
আব্বাস উদ্দিন পিছু ছাড়লেন না। অনেক অনুনয় করে বললেন চেষ্টা করে দেখুন না একবার।ভগবতী বাবু একটা সময় বলে বসলেন -আপনি দেখছি নাছোড়বান্দা।
যান কাজীকে বলুন সংগীত নিয়ে আসতে আমি রেকর্ডিং করে দিব। আর যায় কোথায় আনন্দে আত্মহারা আব্বাস উদ্দিন-নজরুলের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত। ভগবতী বাবু রাজী হয়েছেন। নজরুল উনাকে বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। আধা ঘণ্টা পরে ফিরে এসে -তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন -
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানি তাগিদ।
পুরো গানটা নিজে গেয়েও একবার শুনালেন আব্বাস উদ্দিনকে।
আব্বাস উদ্দিন খুশীতে গদ গদ হয়ে গান খানি তুলে দিলেন -ভগবতী বাবুর হাতে। নির্দিষ্ট দিনে কাজীকে ডেকে সংগীত রেকর্ডিং করলেন ---। সুর এবং সংগীত করলেন আব্বাস উদ্দীন নিজেই।
তার সাথে যোগ দিয়েছেন অনেক শিল্পী, কণ্ঠ দিয়েছেন তাতে। আর যায় কোথায় চারিদিকে এ গানের ধ্বনি বাজতে লাগলো। হিন্দু মুসলিম সবাই অভিভূত।
মুসলমানরা যেন নিজস্ব-সংগীত এবং ঐক্যতার সুর খুঁজে পেলেন।
নজরুলের জয়গান চারিদিকে। মুসলমান শিল্পীরা এবার নজরুলকে চেপে ধরলেন। আমরা আর ছদ্ম নাম ব্যবহার করে গজল কাওয়ালী গাইবো না -আপনি আমাদের জন্য ইসলামী সংগীত রচনা করুন।
এরপর কাজী নজরুল একে একে রচনা করেন - ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ - তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে - -হে মুসাফির নামাজ পড় ---আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ ----- মসজিদেরই পাশে আমায় -কবর দিও ভাই-
যা শুনলে শরীরে শিহরন জাগে।
যা অনুরাগীদের মুখে বাজে। বিশেষ করে রমজানে বেশি। এসব গান থাকবে অনন্তকাল ধরে ।
বলা বাহুল্য এ ধরনের ইসলামী সংগীত আর কোন কবি কিংবা সাহিত্যিক রচনা করতে পারেননি। তিনি বাংলাদেশের রণ সঙ্গীতের রচয়িতা। তার নাম মুসলমান তথা বাঙ্গালীদের মন থেকে মুছে যাবেনা কখনও।

0 মন্তব্যসমূহ