আয়না ঘর পর্ব-০৩
১১ জানুয়ারি, ২০২০, শনিবার। সকালবেলা হাজীগঞ্জ বাজার থেকে বাসে উঠলাম। কাঁচপুর ব্রিজে পৌঁছালে আম্মা কল দেয়। কল রিসিভ করে বলি ঘন্টাখানেক লাগতে পারে। নেমে কল দিব ইনশাআল্লাহ।
যাত্রাবাড়ী মোড়ে নেমে হালকা নাস্তা করলাম। যাব মিরপুর, আমার ফুফাতো বোনের বাসায়। কিছুদিন আপাতত থেকে তারপর দেখেশুনে মেসে উঠবো, এই হলো চিন্তা। হোটেল থেকে নেমে মাত্র এক দু কদম হাঁটলাম, তখন ভরদুপুর। হুট করে পাঞ্জাবি পরিহিত একজন সামনে এসে আমার নাম ফয়েজ কিনা জিজ্ঞেস করলো। হ্যাঁ বললাম। বলে আমাদের সাথে একটু যেতে হবে। সাহস করে বললাম আপনারা কারা? বলে 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী'।
বললাম 'কোনো পোশাক নেই, আইডি কার্ড নেই। আর এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?'
বলে 'গেলেই দেখতে পাবেন'।
আর অমনি শক্ত করে জাপটে ধরে কাছের এক জিপগাড়িতে উঠালো। মুহুর্তেই মধ্যেই দুই হাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ পড়ালো। চোখ বাঁধলো, তার উপর জমটুপি:গলা অবধি ঢেকে যায় যার, তার উপর আবার চোখ বাঁধলো। সাথে থাকা মোবাইল ফোন নিয়ে গেলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই এতসব ঘটে গেলো।
অনুরোধ করলাম, আম্মাকে একটু কল দিয়ে বলি অন্তত ঢাকা পৌঁছেছি, নয়তো চিন্তা করবে। অনুরোধ রাখলো না। রাখবে কেন? মায়ের কান্না, মায়ের আকুতি ওরা কী বুঝবে! হাই বিটের গান ছেড়ে দিলো গাড়িতে, যেন আশেপাশের আওয়াজ কানে না যায়। একই রাস্তায় কয়েকবার যাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে, গোলকধাঁধার মতো। এভাবে ঘন্টাখানেক পর গাড়ি থামলো।
কিছুক্ষন পরে নিয়ে গেল ইন্টারোগেশন রুমে। এয়ার ফ্রেশনারের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ। মাথার ঠিক উপরে দেয়াল ঘড়ি, চারপাশ নিস্তব্ধ, ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ মগজে গিয়ে ঠেকছে। দুর্বিষহ দিনের শুরু, পালা করে জিজ্ঞাসাবাদ আর নির্মম মাইর। এত নির্মমভাবে মানুষকে মারে? শরীরের হাড্ডি-মাংস যেন এক হয়ে যায়।
সেদিনের মতো ইন্টারোগেশন শেষ! হ্যান্ডকাফ খুললো, পোশাক পালটে নতুন পোশাক দিল, চোখ তখনও বাঁধা। নিস্তেজ শরীর দুজন মিলে ধরে দিয়ে আসলো এক সেলে। সারাদিনে ঐ প্রথম চোখের বাঁধন খুললো। কিন্তু বুঝার উপায় নেই কোথায় আছি।
ছোট্ট রুম, লম্বাটে শেইপ, একপাশে একটা খাট পাতা। পুরো রুমে ছাদের সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট জানালা, দেখার উপায় নেই বাইরে কী হচ্ছে। দরজায় ডাবল লেয়ার। একটা জেলখানার মতো শিক, সাথেই লাগোয়া আরেকটা কাঠের দরজা, মাঝখানে একটু ছিদ্র, সেটাও বন্ধ থাকে, ভেতর থেকে খোলার উপায় নেই। দরজার নিচের দিকে ছোট্ট একটা জায়গা, খাবার এদিক দিয়ে দেয়। খুজছিলাম কোথাও কোনো ক্লু পাই কি না, দেয়াল এবড়োখেবড়ো, লেখার সুযোগ নেই কোনো। রুমের এক কোনায় অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা।
বিশাল বড় এগজস্ট ফ্যান, বাইরের শব্দ যেন কানে না এসে, যেন অনুমানও না করা যায় কোথায় আছি। এত জোরে আওয়াজ করে ঘুরতো যেন জেট বিমান যাচ্ছে, তখন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ছিলো, মাইকিং হতো, তাই প্রায় সারাদিনই চলতো।মনে হতো একটা কবরের মধ্যে আছি। আমি একা, আর কেউ নেই।
বাড়ির কথা খুব মনে পড়তো।আম্মা খুব কান্না করছে এটা মনে হতো। বড় মামা মারা গিয়েছে একমাসও হয়নি, এর উপর আমার হারিয়ে যাওয়া..... এভাবে প্রায় প্রতিদিনই জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। রাতে একটু আরাম করে ঘুমাবো, সেই সুযোগ নেই। সারা শরীর ব্যাথা। খাবার যা দেয় গলা দিয়ে নামে না। বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া, টিকে থাকার জন্য খাওয়া।
পাশের সেলে মানুষের উপস্থিতি টের পেতাম, কিন্তু কথা বলার সুযোগ নেই। গার্ড থাকে সবসময়। এক ভাই প্রায় সারাদিনই কান্নাকাটি করতো, চিৎকার করতো, আল্লাহ জানেন উনার উপর দিয়ে কি গিয়েছে।
১০/১২ দিন পর অন্য আরেকটা রুমে পাঠায়। একটু পুরনো ধাচের। কিছুটা মসৃণ দেয়াল। দেয়ালের এখানে সেখানে আলতো করে খোদাই করা অনেক লেখা। একেক রকম হাতের লেখা। কত শত মজলুমের স্মৃতি। কেউ আল্লাহর কাছে বিচার দিচ্ছেন, কেউ মুক্তির দু'আ করছেন। এক জায়গায় অনেকগুলো দাগ কাটা, কতদিন এখানে ছিলেন তার হিসাব, এক দেয়াল ভরে গিয়ে পরের লাইনে এসেছে, দাগ কাটা শেষ হয়না।
সবরকম নির্যাতনের ব্যবস্থাই ছিলো। একেক জনের সাথে একেক রকম নির্যাতন। ওয়াটার বোর্ডিং, ইলেকট্রিক শক, বাঁশ ডলা, ছাদের সাথে ঝুলিয়ে পেটানো....নক উপরে ফেলা, আরো কতো কি! এভাবে ৪২ দিন পার হয়। অতঃপর আমাকে বলা হলো আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারব। তবে..... আমাকে আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
প্রসঙ্গিত, আয়নাঘর থেকে কাউকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া হয়না। হয় ক্রসফায়ার দেয়া হয়, নয়তো মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ভরে, যেন বের হয়ে মুখ খোলার সাহস না করে। তারা নিজেরা কখনও মামলা দেয় না, সাধারণত র্যাবের মাধ্যমে দেয়।
আমাকে হাত চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়, শুরু হয় আরেক আয়নাঘরের জীবন। এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সবমিলিয়ে ২দিন। জিজ্ঞেস না করে পশুর মতো পেটানো যার উদ্দেশ্য। এখানে যেই রুমে ছিলাম সেটা বেশ বড়োসড়ো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। পুরনো বিল্ডিং, জায়গায় জায়গায় ভাঙ্গা, মেঝে-দেয়ালে-ছাদে। মাঝে করিডোর, সেখানে কিছু লাইট জ্বলে, দুপাশে ৫টা করে মোট ১০টা রুম। পালাকরে ওয়াশরুমে নিতো, কাছাকাছি রুম হওয়ায় অনুমান করেছিলাম, মোট ১০ বার তালা খুলতো আর লাগাতো।
সবচেয়ে নির্মম ব্যাপার কি জানেন?
২৪ ঘন্টা চোখ বেঁধে রাখতো, এমনকি রুমের মধ্যেও। সূর্যের আলো দূরে থাক, আলো দেখারই সুযোগ নেই। গার্ড না থাকলে মাঝে মাঝে চোখের নিচ দিয়ে আশেপাশে দেখতে চাইতাম। আমার চশমার পাওয়ার -3.50, একটু দূরেই ঝাপসা দেখি, তাই খুব একটা লাভ হয়নি। ২৪ ঘন্টা হাতে হ্যান্ডকাফ পরা থাকতো। রাত ৯টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত দুহাত পেছনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ দিতো। রাতে যে একটু ঘুমাবো সেই সুযোগ নেই। কিচ্ছুক্ষণ বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে, কিছুক্ষণ উপুড় হয়ে...। কত জঘন্য।
ওয়াশরুমে গেলে শুধু একহাতেরটা খুলতো। হাতে দাগ পড়ে গিয়েছিলো এভাবে।
মেঝেতে একটা কম্বল বিছানো ছিল। এত নোংরা, এর উপর উঠলেই শরীরে চুল্কানি হয়। বাধ্য হয়ে মেঝেতে ঘুমাতাম। উপুড় হয়ে দুই হাত পেছনে রেখে মেঝেতে ঘুমাতে কেমন লাগতো!?এক গার্ড ছিলো একটু ভালো, অনেক অনুরোধ করলাম অন্তত এটা বলুক জায়গাটা কোথায়। বললো র্যাব ১। টানা ৩০দিন এভাবে ছিলাম।
অতঃপর আমাকে নতুন আরেক জায়গায় নিয়ে গেলো। আয়নাঘর নং ৩। সেখানে এক রাত ছিলাম। একদম ছোট একটা রুম, রুমের মধ্যেই কমোড, ঠিকমতো ঘুমালে কমোডে পা চলে যায়, পাশে সর্বোচ্চ ২ হাত প্রশস্ত। সে রাতেই এসে পাঞ্জাবির মাপ জানতে চাইলো। চিন্তায় ঘুম হয়নি আর।
পরদিন সন্ধ্যার দিকে রঙচঙে এক পাঞ্জাবি নিয়ে আসলো, সাথে একটা ট্রাউজার। দ্রুত পরে নিতে বললো। অতঃপর চোখ বাঁধলো, পেছনে দুই হাত দিয়ে হ্যান্ডকাফ, মাথায় হ্যালমেট। একটা গাড়িতে উঠালে, অনুভব করলাম আমার মতো আরো দুইজনকে উঠালো। একজন গাড়ি থামিয়ে তারা নিজেরা নামলো।
- ঐ গাড়ি চেক কর, সাবধান ভেতরে অস্ত থাকতে পারে।
- স্যার অস্ত্র নাই, উগ্রবাদী বই পাইসি।
কিছুক্ষণ হট্টগোল, তারপর আবার গাড়ি চললো।
নিয়ে এলো র্যাব ৩ এ, প্রথমবারের মতো চোখের বাঁধন খুললো। গারদে আমার সাথে আরো ২জন ঢুকলো। মোট ৩জন। নাটকের উদ্দেশ্য মিথ্যা মামলা সাজাবে, এখন বুঝলাম সব। ডেকে নিয়ে ছবি তুললো, সামনে কিছু বই-মোবাইল এসব সাজানো, এগুলো নাকি আমাদের কাছে পাওয়া গিয়েছে, অথচ এসবের নামও কখনো শুনিনি।
আর আমার কাছে এসব থাকবে কেনো। পরদিন ওরিয়েন্টেশন, ব্যাগে জামা কাপড় আর একাডেমিক কাগজপত্র ছিলো। মিথ্যার তো একটা সীমা থাকা উচিত।
এজহারে যা লিখলো.... তার সারমর্ম হলো: "আমরা ২৩মার্চ ২০২০, রাত ৮টার দিকে মতিঝিল মডেল হাইস্কুলের মেইন গেইটের পূর্বপাশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনের সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করার জন্য রাজধানী ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছিলাম। সন্দেহজনক ভাবে ঘোরাফেরা করাকালে তারা আমাদের ধাওয়া করে, ৩জনকে আটক করতে সক্ষম হয়, বাকি ৮/১০ পালিয়ে যায়। নিষিদ্ধ বইগুলো আমাদের সাথে থাকা ব্যাগে ছিলো"
পরদিন মতিঝিল থানায় নিলো, মামলা দায়ের করলো, এমন কোনো ধারা নেই যে দেয়নি, যেন ১/২ বছরেও বের না হতে পারি।
বাড়িতে কল করতে দিলো। আব্বা আম্মা আর ভাইয়া আসলো। থানার গারদে সেদিন অনেক কেঁদেছিলাম উনাদের জড়িয়ে ধরে..... সবমিলিয়ে প্রায় ৭৭০ দিন পর আমার জামিন হয়। সে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা, অন্য এক পোস্টে বলবো ইনশাআল্লাহ....
(গুম ৭২ দিন, জেলে ৭৭০ দিন, সবমিলিয়ে ৮৪২ দিন)
এখনও মামলা চলমান, হাজিরা দিতে হয় মাসে মাসে। ২বছরে ১টা স্বাক্ষীও আসেনি। আসবে কীভাবে? ঐযে গাড়ি থামিয়েছিলো, সেখানকার আশেপাশের পথচারী, রিকশাওয়ালা, ঝালমুড়ি ওয়ালাকে ভয়ভীতি দেখিতে মিথ্যা স্বাক্ষী বানিয়েছে...।
__

0 মন্তব্যসমূহ